ভিন্ন কথা———————————
হক আদায় করেননি এম এ হক
🔸🔹🔸🔹🔸🔹🔸🔹🔸🔹
।। নজরুল ইসলাম বকসী ।।
সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচিত ব্যক্তিত্ব সদ্যপ্রয়াত এম এ হক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মরহুম হারিস মোহাম্মদের মধ্যে একটি অমীমাংসিত লেনদেন নিয়ে আমার আজকের এই লেখার অবতারণা।
সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচিত ব্যক্তিত্ব বর্ষীয়ান রাজনীতিক বিএনপি নেতা এম এ হক গত ৩ জুলাই’২০২০ করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তার মৃত্যুতে সমগ্র সিলেটের জাতীয়তাবাদী অনুসারীদের মধ্যে গভীর শেকের ছায়া নেমে এসেছে।
একই ভাবে সিলেটের সাংবাদিকতা অঙ্গনের সিনিয়র ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হারিস মোহাম্মদ ২০১০ সালের ৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তিনিও জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনুসারী ছিলেন।
উল্লেখিত দুইজনের কেউ আজ ইহজগতে নেই। আমি দুইজনেরই রূহের মাগফেরাত কামনা করছি।
উল্লেখিত দুইজনের মৃত্যুর পর তাদের নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ হয়েছে হচ্ছে। তাদের গুনকীর্তন তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। তবে আমি আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো।
এম এ হক ছিলেন সিলেটের তুখোড় রাজনীতিক ও সম্পদশালী মানুষ। আর হারিস মোহাম্মদ ছিলেন অতি দরিদ্র কিন্তু বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এক বিলাসী সাংবাদিক। বিএনপি আদর্শে বিশ্বাসী বলে দু’জনের ভাব ছিল গলায় গলায়।
এম এ হক ২০০৮ সালে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মেয়র পদে এটি ছিল তার দ্বিতীয় নির্বাচন। এর আগে ২০০৩ সালে তিনি বদরুদ্দীন আহমদ কামরানের কাছে পরাজিত হন। অতি উৎসাহী হারিস মোহাম্মদ বরাবরের মত এবারও এমএ হককে সার্বিক সহযোগিতা করছিলেন। এমএ হক এক পর্যায়ে তার বিপুল পরিমাণ পোস্টার ছাপানোর দায়িত্ব হারিস মোহাম্মদের উপর চাপিয়ে দেন এবং আর্থিক খরচ যা আসে তার হিসাব দিলেই অর্থ পরিশোধ করে দেবেন বলে জানান। তাৎক্ষণিক নগদ কোন টাকা না পাওয়ায় গরীব সাংবাদিক হারিস মোহাম্মদ অত্যন্ত বেকায়দায় পড়ে যান। তারপরও ধারকর্জ করে তিনি রঙিন পোস্টার ছাপিয়ে নিজের বাসায় স্তুপ করে রাখেন। এসময় এমএ হকের কর্মীরা কিছু পোস্টার নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেয়। আর বাকী পোস্টারের বিরাট স্তূপ হারিস মোহাম্মদের বাসায় পড়ে থাকে। সম্ভবত রঙিন পোস্টার না লাগানোর জন্য নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করে একটি নির্দেশ জারি করেছিল। এই পোস্টার ছাপাতে হারিস মোহাম্মদের ৪২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হারিস মোহাম্মদ এই টাকার একটি হিসাব এমএ হককে দিলে নির্বাচনের পরপরই সমুদয় টাকা দিয়ে দেবেন বলে এমএ হক জানান। কিন্তু গরীব হারিস মোহাম্মদের তর সইছিলনা। ঘরে তার বউ বাচ্চা উপোস তার উপর পোস্টারের জন্য তিনি ঋণগ্রস্ত। যাইহোক, ধৈর্য ধরে তিনি অপেক্ষায় থাকলেন।
নির্বাচন শেষ হলো ৪ আগস্ট’২০০৮। নির্বাচনে কারাবন্দী বদরুদ্দীন আহমদ কামরান বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন এবং এমএ হক করুণ ভাবে পরাজয় বরণ করেন।
নির্বাচনের পর এমএ হক মোটেই আর হারিস মোহাম্মদের খোঁজ খবর নেননি এবং তার পাওনা ৪২ হাজার টাকাও দেননি। হারিস মোহাম্মদ বারবার দেখা করেন ফোন করেন কিন্তু এমএ হকের পজেটিভ কোন সাড়া পাননি। একপর্যায়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।
সবার জানা হারিস ভাই একটু মেজাজি ও ক্ষ্যাপাটে ধরনের মানুষ ছিলেন। সত্য কথা যত কঠিনই হোক অকপটে তিনি বলে ফেলতে পারতেন। প্রেসক্লাবের নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলায় সুরমা পারের গার্ডেন টাওয়ারে প্রেসক্লাবের অস্থায়ী কার্যালয় ছিল। একদিন গার্ডেন টাওয়ারের সামনের লনে হারিস ভাই সহ আমরা কয়েকজন সাংবাদিক দাঁড়ানো ছিলাম। এমন সময় এমএ হক তার প্রাইভেট কার সাইড করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন সেখানে। তাকে দেখামাত্র হারিস ভাইয়ের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তিনি সামনে গিয়ে তার টাকা চাইলেন কিন্তু এমএ হক খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে এড়িয়ে যেতে চাইলে হারিস মোহাম্মদ তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলেন। ততক্ষণে এখানে অনেক মানুষ জমা হয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে এমএ হক দ্রুত গাড়িতে উঠে সটকে পড়েন। এর পর থেকে তাদের দু’জনের মধ্যে এনিয়ে তেমন আর কথা হয়নি।
২০১০ সালের ৩ এপ্রিল হারিস মোহাম্মদের মৃত্যু হয়। এসময় তার পরিবারের উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। চরম অসহায় হয়ে পড়ে তার পরিবার। তার বিধবা স্ত্রী সৈয়দা জোৎস্না আক্তার রাণী নাবালক চার সন্তান (৩ কন্যাঃ আশা, দিশা, মিশা ও ১ পুত্রঃ পাশা) নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেন। শহরে থাকা খাওয়া, বাসাভাড়া, বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ, বাজার খরচ ইত্যাদি নিয়ে তিনি সীমাহীন অর্থকষ্টে পড়ে যান। এসময় স্বামীর পাওনা টাকার জন্য বারবার তিনি এমএ হকের কাছে যান এবং সামান্য আর্থিক সহযোগিতা কামনা করেন কিন্তু বিশাল রাজনৈতিক এই নেতা সামান্য মানবতাটুকুও দেখাননি।
গত ৩ জুলাই এমএ হক মারা যাওয়ার সংবাদ শুনে হারিস মোহাম্মদের স্ত্রী সৈয়দা জোৎস্না আক্তার রাণীর পুরনো ক্ষোভ জ্বলে উঠে— যেন শুকনো ক্ষতে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। চিন্তা করেন এতিম পুত্র কন্যাদের নিয়ে জানাজার মাঠে গিয়ে স্বামীর পাওনা টাকার দাবীতে মানববন্ধন করবেন এবং এমএ হকের লাশ আটকাবেন। কিন্তু পরক্ষনেই তার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে আসলো এবং চিন্তায় আসলো নিজ পৈতৃক পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা। ভাবলেন— “গরীব হতে পারি কিন্তু আমার রক্তে প্রবাহিত জমিদারী ঐতিহ্য। তাই সমান্য ৪২ হাজার টাকার জন্য কারো লাশ আটকানো অন্তত আমাকে মানায় না।” তখন তিনি নিজেই নিজেকে কন্ট্রোল করলেন এবং অনুচ্চারিত কণ্ঠে বলে উঠলেন— ইন্নাল্লাহা মাস সোয়াবিরিন…..।